গ্রাম থেকে বাল্য বিবাহ দূর করার জন্য মনির যুদ্ধ

'মনি, বর্তমানে বাল্যবিবাহ এবং শিশু শিক্ষা সম্পর্কে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য করেছে তার নিজস্ব সংগঠন 'বিডি প্যাক্স ফাউন্ডেশন'।
panel_hero_image_1.jpg
Source: panel_hero_image_1.jpg
Moni with her children's club
'মনি, বর্তমানে বাল্যবিবাহ এবং শিশু শিক্ষা সম্পর্কে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য করেছে তার নিজস্ব সংগঠন 'বিডি প্যাক্স ফাউন্ডেশন'। 
 
মনির যখন ৮-৯ বছর বয়স, তখন তার ক্লাস সেভেন পড়ুয়া বোনের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। তার বোনের বয়স তখন ছিল ১৩-১৪ বছর। বিয়ের সাত দিনের মাথায় মনির বোন তাদের বাড়িতে চলে আসে। সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল এবং সবসময় বলতে থাকতো যে সে আর শশুড়বাড়িতে যাবে না। সেখানে তাকে নির্যাতন করা হয়। বাড়ির সবাই মনে করে হয়তো সে নির্যাতনের শিকার হয় নি, ছোট বলে ভাবছে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে মনির ছোটবেলা কাটে, যেখানে তার পরিবারের একজন বিয়ে নিয়ে প্রায় আতঙ্কিত দিন কাটাচ্ছে। তাদের সাজানো পরিবার ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে যায়। এসব দেখতে দেখতেই মনি বড় হয়। তখন থেকেই মনি পরিকল্পনা করে, সমাজের এই ধরণের সমস্যা দূর করার জন্য সে কিছু করবে।
 
মনির যখন বারো বছর বয়স হয়, তখন সে ব্র্যাকে আবেদন করে, ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত হয়। সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মনি তখন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের বিষয়ে কিশোর-কিশোরীদের প্রশিক্ষণ দেয়। তাদেরকে বয়ঃসন্ধিকাল, বাল্য বিবাহ, নারী নির্যাতন, শিশু পাচার, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি সম্পর্কে জানায়। কীভাবে কাজ করলে নিজের ভবিষ্যতের উন্নতি করা যাবে, কী করলে নিজে পরিবারের বোঝা হয়ে উঠবে না এসব বিষয়েও মনি তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। 
 
তারপর একসময় ব্র্যাক থেকে মনির স্কুলে তারা চলে আসে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা মনিকে প্রশিক্ষণ দেয়। অজপাড়াগাঁয়ে থাকা মনির পক্ষে সে সময় এই ধরণের মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া খুবই কঠিন ছিল, কিন্তু সে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ১৬২ টা স্কুলের শিক্ষার্থীর সঙ্গে মনি প্রশিক্ষণ নেয়। কীভাবে নিজেকে উন্নত করে তোলা যায়, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা ইত্যাদি বিষয়ে মনি প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত আগের চেয়ে আরও উন্নত করে তুলতে থাকে। তার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারভিয়্যূও দেয়।
 
সেখান থেকে মনিকে জাতিসংঘের সভায় বক্তৃতা রাখার জন্য নিউইয়র্ক পাঠানো হয়। এতবড় একটি মঞ্চে নিজেকে তুলে ধরতে পেরে মনির উৎসাহ আরও অনেক বেড়ে যায়। দেশে ফিরে এসে সে নিজের একটি সংগঠন চালানোর পরিকল্পনা করে। "বিডি প্যাক্স ফাউন্ডেশন" নামে সে একটি সংগঠন শুরু করে। বিডি প্যাক্স ফাউন্ডেশনের অধীনে সে "শাইনিং ফিউচার ফর চিলড্রেন" নামে একটি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। এই সংগঠনের মাধ্যমে সে শিশুদেরকে বিনামূল্য পড়াশোনা করায়। বাচ্চাদেরকে উৎসাহিত করে তাদের যেকোন সমস্যা তার সঙ্গে শেয়ার করতে। বাচ্চারাও তা করে। প্রতিটি বাচ্চাকে মনি বলে, "প্রতিদিন সকালে উঠে মা-বাবাকে সালাম করো, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় সালাম করো, দেখবে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এমন কেউ নেই যে তোমাকে আটকাবে!" মনির নিজের দিনও শুরু হয় বাবা-মাকে সালাম করে।
 
Moni with her adolescent club
 বিনামূল্যে পড়ানোর পরেও কেউ যদি তাকে কোনোপ্রকার সম্মানী দিতো, সেটা দিয়ে সে বাচ্চাদের জন্য খেলনা, চকলেট ইত্যাদি উপহার কিনতো। 
 
এরপর সে "য়্যূনিক এডোবেশন ক্লাব" নামে আরেকটি ক্লাবের কার্যক্রম শুরু করে। এটিও বিডি প্যাক্স ফাউন্ডেশনের অধীনে। মনি নিজে ব্র্যাক কিশোরী ক্লাবের সদস্য ছিল, তাই সেসময় তার মনেহয় সে যদি প্রত্যেকটা গ্রামে একটা করে এ ধরণের ক্লাব চালু করতে পারে, তাহলে কিশোরীরা অনেক কিছু শিখতে পারবে। তার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি মেয়েকে নিঃসঙ্কোচে তাদের মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা শেয়ার করতে উৎসাহিত করা। অনেক মেয়ে নিজের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা ডাক্তারের সঙ্গেও শেয়ার করতে পারে না, ফলে এর ভুক্তভোগী হয় সে নিজে। মনি চায় এই অপ্রয়োজনীয় সংকোচ যাতে কোনো মেয়ের মধ্যে না থাকে। 
 
মনি হিমু পরিবহনের সঙ্গেও কাজ করে। হিমু পরিবহন মূলত ক্যান্সার সচেতনতা নিয়ে কাজ করে। মনি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জনসমাগমের মধ্যে ক্যান্সার সম্পর্কে তাদেরকে বিভিন্ন তথ্য দেয় এবং এই সম্পর্কে সচেতন করে। 
 
সম্প্রতি মনি তার এলাকায় ময়লা ফেলা বন্ধ অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেয় তার সংগঠন থেকে। সে চায় তার এলাকায় কোনো ময়লা থাকবে না। তারা সে অভিযানে সকল ময়লা পরিষ্কার করা এবং সেই সাথে সকলকে ময়লা না ফেলার ব্যাপারে সচেতন করার পরিকল্পনা করে। 
 
অনেকে মনে করে মনি অন্যদের থেকে টাকা নিয়ে স্কুল চালায়, বাচ্চাদের জন্য কাজ করে। অথচ মনি নিজের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে তার সংগঠনের ফান্ডিং করছে, প্রতিনিয়ত নিজের উপার্জন দিয়ে গড়ে তুলছে অন্যের ভবিষ্যতের ভিত।
 
মনি মনির কাজের জন্য প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়। এমনকি তার পরিবারও তার জন্য বাধার সম্মুখীন হয়, বিভিন্নজন তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে। কিন্তু মনি তাতে থেমে যায় নি। মনে মনে করে তার কাজই তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাই কারো কথায় সে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। 
 
মনি যখন কোনো বাড়িতে বাল্যবিবাহ আটকানোর  জন্য যায়, তাকে সকলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। তার কথা কেউ শুনতেই চায় না। কিন্তু সে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে যে আঠারো বছরের চেয়ে আঠারো ঘন্টা কম হলেও মেয়ের বিয়ে দেয়া আইনত অপরাধ। বেশিরভাগ সময়ই মেয়ের মা-বাবা মনিকে বলে, "আমাদের মেয়েকে আমরা বিয়ে দেব, তুমি বলার কে?" এ ধরণের পরিস্থিতি মনি বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে।
 
মনি নিজ উদ্যোগে প্রায় ২০০ টির মতো বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। মনির প্রতিটি ক্লাবে সদস্য সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের মতো। প্রতিটি ক্লাবে প্রশিক্ষণের জন্য মনি একজন ছেলে ও একজন মেয়েকে রেখেছে। তারাই চেইন আকারে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। 
 
মনির মতে প্রতিটি মানুষের উচিত তার মা-বাবাকে সম্মান করা। এই পৃথিবীতে নিজের পরিবারের চেয়ে আপন আর কেউ নেই। তাই সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তার পরিবারের সকলকে খুশি রাখতে। মনি কারো কাছে তার কাজের প্রতিদান চায় না, সে মনে করে ভালো কাজের প্রতিদান তাকে প্রকৃতিই দেবে।
 
 
আঠারোর বছর বয়সী মনি তার সমাজ সচেতনতামূলক কাজের কারণে ২০১৭ সালে অশোকার একজন "য়্যূউথ ভেঞ্চার" হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। যা তার কাজের স্পৃহা এবং গতিশীলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। 
 
মনির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো বাচ্চাদের জন্য কাজ করা আর নিজের বয়সী মেয়েদের নিয়ে কাজ করা। বাচ্চারা যাতে বিপথে না গিয়ে সুন্দর একটি জীবন পায়, সেটা নিশ্চিত করাই মনির লক্ষ্য। বাচ্চাদের থেকে মনি যে বিপুল পরিমাণ ভালোবাসা পায়, তাই মনির কাজের স্পৃহাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। 
 
মনি চায় প্রতিটি মেয়ে বাল্য বিবাহ, নারী নির্যাতন, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানুক। তার সংগঠনের মাধ্যমে সে সারাজীবন শিশু এবং মেয়েদের জন্য কাজ করে যেতে চায়। মনি প্রতিটি মেয়েকে বলে, "এমন কোনো সংকোচ তোমার মধ্য রাখবে না যা তোমাকে শেষ করে দেয়"।
Moni's Family
 
মনি চায় সারাজীবন এভাবে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে। পাওয়ার মধ্যে কারো সুন্দর ভবিষ্যৎ, একটুখানি হাসি আর অনেকখানি ভালোবাসা - এই বা কম কী?

তুমি বা তোমার পরিচিত কেউ যদি সমাজে মনির মত ছোট বড় পরিবর্তন আনতে কাজ করে থাকে এবং তাদের বয়স ১২ থেকে ২০ এর মধ্যে হয় তাহলে এক্ষুনি বাংলাদেশে আশোকার ইয়োথ ভেঞ্জার প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করো।

আবেদন করতে ক্লিক করোঃ

এই প্রতিবেদনটি ইংরেজীতে পড়তে এখানে ক্লিক করো

লিখেছেন - জান্নাত মজুমদার
সম্পাদনা - আলমগীর কবির 

Written  - Alamgir Kabir