পনেরো বছর বয়সী আজমাইন বর্তমানে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে এবং ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে নজর কেড়ে নিয়েছে সকলের।
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আজমাইন ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী ছিল। সে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই সে প্রোগ্রামিং শুরু করে। সেই সাথে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিকস ইত্যাদি বিষয়ে কাজ শুরু করে। আজমাইন বর্তমানে তার নিজের আবিষ্কৃত কিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন করার চেষ্টা করছে।
আজমাইনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি হলো বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ইশারা ভাষাকে শনাক্ত করে আমাদের উপযোগী করে কনভার্ট করবে। আজমাইন বলে, "এর মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের যে দূরত্ব, তা দূর হবে।"
আজমাইন ছোটবেলায় শুধুই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী ছিল, চেইঞ্জমেকিংয়ের কনসেপ্ট সম্পর্কে তার কোনো ধারণা তখন তার ছিল না। পঞ্চম কী ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় আজমাইন একটি ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেখানে অনেক বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীরাও অংশ নিয়েছিলো। যে প্রতিযোগিতাটিতে প্রথম হয় সেও সেরকম একজন। তাকে তখন মঞ্চে ডাকা হয় কিছু বলার জন্যে। মঞ্চে উঠে সে তার মতো করে ইশারা ভাষায় কথা বলতে থাকে, আরেকজন তখন তার বলা কথাটিকে সবার উদ্দেশ্যে বুঝিয়ে বলে।
সেই মুহূর্তে আজমাইনের মনেহয় এই কাজটিকেই প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও সহজভাবে করা যায় কিনা। আর সেই ছোট্ট ভাবনাটা থেকেই এই চমৎকার কার্যকর প্রযুক্তিটির উৎপত্তি।
আজমাইন সেই ভাবনাটা থেকেই চেইঞ্জমেকিংয়ের ধারণাটা পায়। এবং তখন থেকেই চারপাশের পরিবর্তন সাধনের জন্য সে আরও আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে থাকে।
সেই চিন্তা থেকেই সে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে। তা হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা। যেই ওয়েবসাইট মূলত মানুষের কাজকে আরও সহজ করে দিয়ে মানুষের সময় বাঁচাবে। ওয়েবসাইটটার কাজ একটা উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যাক। ধরা যাক আমি একটি স্মার্টফোন কিনব। এই স্মার্টফোন কেনার জন্য আমার বাজেট ২০ হাজার টাকা। এখন আমার বাজেট অনুযায়ী এবং আমি কী ধরণের ফিচার আমার স্মার্টফোনে চাই সে অনুযায়ী একটি ফোন বেছে নিতে আমার অনেক সময় লেগে যাবে। তারপরেও আমার চাহিদা অনুযায়ী ফোনটি হয়তো আমি খুঁজে বের করতে অসফলও হতে পারি।
এই সাইটটার কাজই হলো মূলত আমার বাজেট এবং চাহিদা অনুযায়ী স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি ইলেকট্রনিক পণ্য আমার জন্য বাছাই করে দেয়া। পুরোটাই হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে।
তার এই দুটো আবিষ্কারই এখনো আন্ডার কনস্ট্রাকশনে। এছাড়া আরও কিছু আবিষ্কার আছে যেগুলোর কাজ পুরোপুরি শেষ হলে সেগুলো মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
আজমাইন তার বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য করা আবিষ্কারের জন্য অশোকার একজন 'য়্যূউথ ভেঞ্চার' হিসেবে নির্বাচিত হয়। যা তার কাজের গতিপথকে করেছে আরও সুগম; শিক্ষাকে করছে বিস্তৃত।
সে বলে, অশোকার মাধ্যমে তার চেইঞ্জমেকিংয়ের ধারণা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। অশোকার য়্যূউথ ভেঞ্চার নির্বাচিত হওয়ার পর সে অশোকার মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ নেয়। সেখানে সে অনেক বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানতে পারে। অন্যান্য চেইঞ্জমেকারদের কাজ সম্পর্কে জানার কারণে তার চেইঞ্জমেকিং সম্পর্কে তার ধারণাটা আরও ব্যাপকতা লাভ করে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আজমাইনের মতো কিশোরের পক্ষে এ ধরণের কাজ শুরু করা এবং চালিয়ে যাওয়া যে কতবড় চ্যালেঞ্জ তা সহজেই বোঝা যায়। আজমাইন বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। প্রথমত যেটা হয়েছে তা হলো, পরিবার থেকে চাপ এসেছে। এতটুকু একটা ছেলে হয়ে ও যখন এ ধরণের কাজে সময় ব্যয় করছে তখন তার অভিভাবক ভেবেছেন সে বুঝি সময়ের অপচয় করছে। তাই তাকে পড়াশোনার প্রতি চাপ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এসব কাজে ফান্ডিংয়ের প্রয়োজন হয় কিন্তু সেটা আজমাইনের মতো পনেরো বছর বয়সী কিশোরের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ! তৃতীয়ত, এমন অনেক কিছু তার প্রয়োজন হয়েছে তা বাংলাদেশে পাওয়া বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে আজমাইন এসব চ্যালেঞ্জ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করে চলেছে।
যেমন, আজমাইন ও তার পুরো গ্রুপ মিলে তারা ওয়েব ডিজাইনিং ডেভেলপমেন্টের সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমে তাদের ফান্ডিংয়ের সমস্যা অনেকটা দূর করলো। এভাবে আজমাইন শত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে এবং তা বাস্তবায়ন করে চলেছে।
আজমাইনের কাজের জন্য তার বেশ বড় সংখ্যক প্রাপ্তি রয়েছে এ বয়সেই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশের রিয়েলিটি শো "উদ্ভাবকের খোঁজে"-তে ২৫০০ জনের মধ্যে সেরা দশে অবস্থান করে নেয়া। এই অবস্থান তার শ্রবণ এবং বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য করা প্রযুক্তিটির জন্যে। এছাড়াও সে নেপালে গিয়েছিলো একটি ইন্টারন্যাশনাল টিন কনফারেন্সে স্পিকার হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিযোগিতাতেও আজমাইন সারাদেশের সকল প্রতিযোগীর মধ্যে থেকে সেরা দশে অবস্থান করে নেয়। আজমাইন ২০১৬ এবং ২০১৭ - টানা দুই বছর 'চিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেস'-এ প্রথম স্থান অধিকার করে।
আজমাইনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের দৈনন্দিন, প্রচলিত এবং অপ্রচলিত সমস্যা দূর করা। এছাড়া তার সকল আবিষ্কারকে আলোর মুখ দেখানো এবং ভবিষ্যতে আরও আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাড়ানো। তার ইচ্ছা তার কাজে আরও জনবল নিয়োগ করা এবং কাজের মাধ্যমে আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানো।
আজমাইন সকলের উদ্দেশ্যে বলে, "আমরা প্রত্যেকে একেকজন চেইঞ্জমেকার হতে পারি।" তার মতে যখন কেউ একজন একটা কিছু পারে যা থেকে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব, তখন তার উচিত তার পারাটাকে কাজে লাগিয়ে যতটুকু সম্ভব সমাজের সকলের জন্য কাজ করে। পনেরো বছর বয়সী আজমাইন তাই তার আবিষ্কারগুলো নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই করছে। কিশোর আজমাইন চায় সমাজের বৃহৎ পরিবর্তনের একজন ক্ষুদ্র অংশীদার হয়ে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতে।
Written - Alamgir Kabir